এক.
অনেকক্ষণ ধরে খুঁজছি। একটা ডিসপেন্সারিও বাদ দেই নি। না, পেলাম না।
সেই ক্লিনিক থেকে বের হয়ে হাঁটতে হাঁটতে সরকারী হাসপাতালগুলোর কাছে এসে পড়েছি। ক্লিনিকে কেবিন এটেন্ডার অবশ্য বলে দিয়েছিল স্যালাইনটা রেয়ার, সুরভী ঔষধালয়ে পাওয়া যেতে পারে। মহিলা যদি জোড় গলায় ‘পাওয়া যেতে পারে’ না বলে ‘ কেবল পাওয়া যাবে’ এই সত্য কথাটা বলত তবে এত পক না হেঁটে রিকশা নিয়েই চলে আসতাম।
এখন সুরভী ঔষধালয়ের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। ছোট একটা দোকান। ভীড় বেশ। অনেক খদ্দেরকে দেখলাম আমার মতই ঘেমে একাকার। ভীড়ের মাঝ দিয়ে এগিয়ে ডাক্তারের প্রেসকিপশনটা এগিয়ে দিলাম কাউন্টারের লোকটার দিকে। লোকটার মুখের দিকে তখনও তাকায়নি। পাশের একজনের কনুই বারবার আমাকে আঘাত করছিল। লোকটির সেদিকে কোন খেয়াল ছিল না, সে ব্যাস্ত তার ওষুধগুলো বুঝে নিতে। বেশ দূরের এক ক্লিনিক থেকে হেঁটে এসেছে, তার রোগীর বোধহয় খুব তাড়া। বারবার ফোন আসছে। পকেটে হাত দিচ্ছে, কনুই আমাকে গুতোচ্ছে। আমি কনুই এড়িয়ে একটু সরে গেলাম। যার হাতে প্রেসক্রিপশন দিয়েছিলাম তার দিকে এবার তাকালাম। লোকটাকে তো আমি চিনি।
চিনি মানে ঠিক পরিচয় নেই, তবে গত এক সপ্তাহে কমপক্ষে চার পাঁচবার তার সাথে আমার দেখা হয়েছে। দেখা হয়েছে বাসে। সকালে যখন বাসে উঠি ক্লিনিকের উদ্দেশ্যে তখন লোকটাও ওঠে। ও ব্যাটার বাসাও মিরপুরে আমাদের ওদিকেই হবে। এক সপ্তাহ ধরে সকাল সন্ধ্যা ডিউটি আমার এই ক্লিনিকে যাওয়া আসা। আমার বড় বোনের শাশুড়ির একটা অপারেশন হয়েছে। কোন এক মেয়েলী রোগ, আমি অত বিস্তারিত জানার চেষ্টা করিনি। কিন্তু মা’র গোয়ার্তুমির কারণে দায়িত্ব এড়াতে পারিনি। মিরপুর থেকে মোহাম্মাদপুর কাছে। বড় আপুদের বাসা ঢাকার সেই অন্য প্রান্তে সূত্রাপুর। রোজ খাবার নিয়ে যেতে হয়। মা’র ভাষায় আমি উড়নচন্ডী, আমাকেই ক্লিনিকে আপুর শাশুড়ির সব ফাইফরমাস খেটে দিতে হচ্ছে। উড়নচন্ডী কথাটা তো মিথ্যেও নয়, কি উপায়। মানা করা যাচ্ছে না। যদিও আমি ক্ষুব্ধ মনে মনে ...
মানুষকে দেখে নাকি তার কর্মকান্ড বোঝা যায়। মিললো না। লোকটাকে আর তার বাসে রোজকার আচরণ দেখে মনে হয়েছিল ব্যাটা কোন সরকারী অফিসের কেরাণী। খোঁচা খোঁচা আধা কাঁচা আধা পাকা দাঁড়ি থাকে রোজ মুখে। মনে হয় ওর চেয়ে যেন আর বাড়েও না, কমেও না। ঢিলে ঢালা প্যান্ট। ইন না করা এক রঙা শার্ট গায়। হাতে একটা খাবারের থলে। থলেটা চটের তৈরী এবং ছেড়া। কন্ডাকটার ভাড়া চাইতে আসলেই শুরু হয় তার একই ডায়ালোগ- ‘ঐ মিয়া রোজ আট টাকা দিয়া যাই, আজকা বারো টাকা হইলো কেমনে...’ সাথে সাথে আবার কিছু লোক তাল মেলায়। যারা তাল মেলায় তারাই আগে বারো টাকা বের করে দেয়। ঐ লোক আট টাকাই বের করে বুক পকেট থেকে গুণে গুণে। দুটাকর নোট সব, তারপর কন্ডাক্টরকে হিসাব দেখায়, বলে, ‘সরকারী যে রেট তাতে আট টাকার বেশি ভাড়া হয় না আর তোমরা নিতাছ মিয়া বারো টাকা। আট টাকার বেশি দিমু না। জুলুম পাইছো। দেশে আইন আদালত আছে না। ’ আইন আদালতের কথা শুনে কেউ আবার মুখ খোলে, ‘আরে আইন, সে আছে খালি কাগজ কলমে, কলকাঠি নড়ে অন্যখানে। গরীবের লাইগ্যা কোন আইন নাই।’ আরেকজন বলে ওঠে, ‘নাই তো আমাগো লাইগ্যাই , আমরা জনগণ আইন ঠিক মতো মানলে ...’ এক দু’জন করে শুরু হয়ে যায়। কথা নদীর মত, চলে যায় রাজনৈতিক অস্থিরতায়। বাসে দু কান খুলে দাঁড়িয়ে থাক দায় হয়। লোকটা অবশ্য বসেই আছে। কন্ডাকটার তখনও তার সাথে ঝগড়া করছে। কেউ একজন বলে ওঠে, ‘ভাই সবাই দিতাছে, শুধু শুধু ক্যাঁচাল কইরা সাত সকালে মাথাটা নষ্ট কইরেন নাতো, একেতো রাস্তা ঘাটে কখন কোন গাড়ীতে আগুন দেয় তার নাই ঠিক, তারোপর আপনাগো ক্যাচাল।’ লোকটাও খ্যাপে ,‘আপনাগো লাইগ্যাই তো ওরা পাইয়া বইসে’ অবশ্য দুটাকার নোটগুলো সাথে আরেকটি দু টাকা যোগ করে লোকটি। কন্ডাকটার গজ গজ করতে করতে টাকাটা নেয় কিন্তু মুখে বলতে ছাড়ে না, ‘মিয়া কাল থেইক্যা হাঁইটাই যাইয়েন।
লোকটা কোনদিনই হাঁটে না। সে পরের দিনও তর্ক জোড়ে। দুটাকা ঠিকই কম দেয়। একটা গর্ব তার চেহারায় লক্ষ্য করা যায়। সেই একা বিজয়ী আর সবাই লুজার।
দুই.
নিজেকেও আমার এখন বড্ড লুজার মনে হচ্ছে। সর্ব প্রথমে যে ডিসপেন্সারিতে জিজ্ঞেস করেছিলাম সেখানের একটা ভদ্র চেহারার ছেলে বলেছিল, ‘এ কোম্পানীর স্যালাইন পাবেন না আশেপাশে। অন্য কোম্পানীর দেই?’ আমি সম্মত হতে পারি নি। অন্যের শাশুড়ি আমি কেমনে সিদ্ধান্ত দেই। ছেলেটি আরও বলেছিল, ‘আরে ভাই, সামান্য একটা স্যালাইন ইতো। এক কোম্পানীর নিলেই হয়।’ ‘ক্লিনিক এটেন্ডার আপায় মানা করেছে অন্যটা নিতে’ জানাই। সে হাসে। বলে, ‘আরে মিয়া, সব ব্যবসা, ওষুধ কোম্পানী আর দোকানের লগে ক্লিনিকের চুক্তি হৈছে। আগে আমগো লগেও ঐ ক্লিনিকের চুক্তি ছিল। কিন্তু হেরা বেশি ভাগ চায়। আমরা চুক্তি করি নাই আর। হুদাই হাঁটবেন, হাঁটেন। ’
চিন্তা করলাম এর পর সব ওষুধ ঐ ছেলের কাছ থেকে নিলে কেমন হয়? আসলে ভালো হয় না, ক্লিনিক এটেন্ডার মানবো না। নিজের মা হলে আমি জোড় করতাম, অন্যের মার বিষয়। আমার জোড়ে হিতে বিপরীত হলেও হতে পারে।
...আমি বাসে চেনা সেই ওষুধওয়ালার হাত থেকে স্যালাইনের প্যাকেট গুলো হাতে নিলাম। নেড়ে চেড়ে দেখলাম। নাম মেলালাম। ব্যাটা মুখ খুললো, ‘ভুল নাই, সকাল থেকে পঞ্চাশ পিস বেচছি। আর কোথাও নেই এইডা। ’
আমি দাম হিসেব করছি। প্রতিটার দাম লেখা সত্তুর টাকা । পাঁচটার মোট দাম হয় তিনশত পঞ্চাশ। পাঁচশ টাকার নোট এগিয়ে দিলাম। ব্যাটা ফেরত দিলো মাত্র পঁচাত্তর টাকা। বললাম, ‘কত করে?’
‘একশ পাঁচ টাকা।’
‘কেনো? গায়ে লেখা তো...’
‘আরে ভাই, এইডা মার্কেট আউট আইটেম, কোন দোকানে নাই। আমাগো বেশি দামে কিনা আনতে হইছে, নিবেন, কাস্টোমার ডাকতাছে, নিলে নেন, না নিলে তাড়াতাড়ি কন।’
অগত্য আমি পঁচাত্তর চাকা নিয়েই ফিলে এলাম। শালা বাসে দুই টাকা নিয়ে যা ক্যাচাল করে, সেই লোক এইখানে করছে পুকুর চুরি। হায় কি বিচিত্র! আমি একরাশ ক্ষোভ মনে পুষে হাঁটা শুরু করলাম। রিকশা নিয়ে খরচের পরিমাণ আর বেশি বাড়িয়ে বড় আপুর চোখে আর ছোট হবার চেষ্টা করলাম না। হঠাৎ মনে খচখচ করে উঠল- নিজেতো মেনে নিলাম। বড় আপু আর দুলাভাই না আবার আমারে চোর ভাবে?
তিন.
ক্লিনিকের সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময়ই মোবাইলে ফোন এল। আপুর ফোন। ফোন ধরেই বকল। আমি বকা বকা শুনতে শুনতে তার সামনে গিয়ে প্যাকেট হাতে দিলাম।
দুলাভাই এসেছেন অফিস থেকে। বলল, ‘এতক্ষণ লাগলো?’
‘আশেপাশে নেই, সেই অনেক দূর হেঁটে তবে..’
এটেন্ডার আসায় আর বেশি বলতে হলো না, তবে মহিলা জিজ্ঞেস করে নিলেন সুযোগে, ‘কত করে নিয়েছে সুরভী?’
জানালাম। বললো ‘ঠিকই নিয়েছে।’ আমি বড় আপুর কাছে চোর হওয়া থেকে বাঁচলাম। পঁচাত্তর টাকাই ফেরত দিলাম। আপা রেখে দিতে বললো। রাখলাম।
সকাল আর দুপুরের খাবার আমি এক সাথেই নিয়ে আসি। সন্ধ্যায় বাসায় গিয়ে আবার রাতের খাবার আর নিয়ে আসি, তারপর বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত প্রায় বারোটা। বেশ একটা রুটিন হয়ে গেছে আমার। এই রুটিনের মধ্যে রীতুর বোকা ঝকাটাও অন্তর্ভূক্ত।
রীতু আমার গালফ্রেন্ড। আমার মত বেকার ভবঘুরেরও গালফ্রেন্ড থাকে সেটা অনেকে মেনে নেয় না। চাকুরীজীবি বন্ধুরা মোটও না। আমি বলি, ‘ কবিতা লিখি তো, কবিরা সহজেই মেয়ে পটাতে পারে।’ কিন্তু সত্যি কথা বলি না, বলি না যে আজও আমার একটা কবিতাও রীতু পড়ে নি। মেয়েরা ওসবে পটে না। পটে- কারণ ওরা পটতে চায়। বেকার, চাকুরে বা শিল্পপতি সেখানে কোন ফ্যাক্টরও নাই। যদি কোন ছেলে আবিষ্কার করে ফেলে কোন মেয়ে তার জন্য কেনো পটেছে, তবেই হয়েছে, ও পথ তার জন্য শেষ। আর কেউ পটবে না। কেনো? সে এ রহস্য...
রীতুও তাই কেনো পটেছে আমি ভাবি না। আমি রীতুকে নিয়ে হ্যাপি। যদিও গত পাঁচদিন ধরে তার সাথে দেখা নেই। কথাও বলি হাসপাতালে ফাইফরমাশ খাটার ফাঁকে ফাঁকে। রীতু বারবার কথায় ছেদ পড়ায় খ্যাপে যায়। বলে, ‘তুমি কি চাকর নাকি, তোমার তালুই মা’র আর কেউ নেই’।
‘তালুই মা আবার কে?’
‘তোমার বড়াপুর শাশুড়ি তোমার কি হয়?...’
আজ সন্ধ্যায় দেখা করব কথা দিয়েছি। এক বান্ধবীর বাসায় যাবে নোট নিতে। ফেরার সময় আমার থাকার কথা ঐ ছেদু মিয়ার চটপটির দোকানে। আমি বেজায় খুশি। কিন্তু হাতে কোন টাকা পযসা নেই তেমন।
মা সারাক্ষণ বকে। অনার্স পাস করে বসে আছি। চাকুরীর চেষ্টা করি না। করব না সেটা মা বুঝে গেছে। বলে বাবার সাথে দোকানে বসতে। মিরপুর ১ থেকে ২ এ যাবার বড় রাস্তার ধারে বাবার দুটো দোকান। একটাতে নিজে বসে। ওটা একটা কনফেকশনারির দোকান। খুব চালু। আমার বসতে ইচ্ছে করে না। বাবাও চায় না আমি দোকনদারী করি। বাবার কাছ থেকে তেমন একটা টাকা পয়সা চাই না আমি। মাস ছয়েক আগে একদিন দোকানে গিয়ে হাজির হলাম সকাল সকাল। বাবাতো অবাক। বললাম দোকানদারী করার টেস্ট দিতে এসেছি। বাবা হাসলেন। দুপুর হতেই বললেন, ‘বাসায় যা, আর কি দরকার বল?’
বাবা বুঝতে পেরেছে তাতে আমি অবাক হয় নি। বরং বললাম, ‘আমার সাত হাজার টাকা লাগবে।’ উনি বিনা বাক্যে দিয়ে দিলেন। কেবল বললেন, ‘তোর লেখালেখি কেমন চলছে? একটা বই টই বের কর। টাকা লাগলে আমি দেবো।’
বললাম, ‘বাবা সময় হয়নি এখনও।’
টাকাটা দিয়েছিলাম শুক্কুর নামে এক ভূতপূর্ব রিকশাওয়ালাকে। শুক্কুর একসিডেন্ট করেছিল। মারামারি বেঁধেছিল রাস্তায়। পুলিশ বেধরক পেটাচ্ছিল। শুক্কুর রিকশা সরাতে দেরী করে ফেরেছিল। লাঠির একটা বাড়ি লেগেছিল ঠিক হাঁটুর উপর। হাসপাতালে শুয়ে ছিল কয়েকদিন। ডাক্তার বলেছে আর কোনদিন রিকশা চালাতে পারবে না।
শুক্কুরের ছোট্ট একটা মেয়ে আছে। তিন বছর বয়স। আমি যেখানে রোজ চা খাই সে দোকানের পেছনে বস্তিতে সে থাকে। মেয়েটাকে নিয়ে দোকানে আসতো। আমি চকলেট কিনে দিতাম। শুনলাম ওদের পরিবারে খাবার কোন সংস্থান নেই ক’দিন ধরে। এক লাঠির বাড়িতে এক পরিবার অনাহার- হাসবো না কাঁদবো বুঝতে পারি না! ওর জন্যই টাকাটা নিয়েছি বাবার কাছ থেকে। বাজারের যুব নেতা শান্টু ভাই আমার পরিচিত। তাকে বলে একটা কাঁচামালের দোকান ব্যবস্থা করেছি। এক হাজার টাকা ভাড়া আর রোজ বখরা বিশ টাকা। বাড়তি তেমন এডভান্স দেয়া লাগলো না। কেবল এক হাজার ভাড়া অগ্রীম দিতে হলো। বাকী টাকা দিলাম পুঁজি হিসাবে। ব্যবসা ভালো হচ্চে। ছ মাসে একটা দোকান থেকে দুটো দোকন বানিয়েছে। একটাতে ওর ছোট ভাইকে এনে বসিয়েছে। শুক্কুর পরিশ্রমী লোক। ও অবশ্য আমার কাছ থেকে সাহায্য নিতে চায় নি। শেষে আমি সমাধান দিয়েছি, বলেছি রোজ আমাকে পঞ্চাশ টাকা করে দিতে। ভালোই হয়েছে আমার চা সিগারেটের টাকাটা চলে আসে। ...গত এক সপ্তাহে কোন টাকা নেয়া হয়নি। দেশের যে অবস্থা, অবরোধ, হরতাল, কি জানি লাভ করতে পারছে কিনা। আমি তাই যাই না। লস হলেও সে আমাকে টাকা ঠিকই দেবে আমি জানি।...
যাক, বড় আপুর পঁচাত্তর টাকা আর সকালে আম্মার দেয়া এক শ টাকার থেকে এখন আছে আশি টাকা। চটপটির টাকা হয়ে যাবে।
মনে বেশ আনন্দ। বিকাল হতেই সব খাবার পাত্র টাত্র বড় আপুর কাছ থেকে নিয়ে রওয়ানা হলাম। আগামী কাল আবার অবরোধ, আপু বলল, ‘দেরী করিস না, তাড়াতাড়ি চলে আসিস’।
নিচে নেমে কিছু দূর এগিয়ে গিয়ে সেই প্রথম ওষুধের দোকানের সামনে দাঁড়ালাম। ছেলেটা একা দোকানে। ভীড় নেই। এগিয়ে গেলাম, ‘ভাই সুরভীতেই পাইছিলাম ওষুধ, ব্যাটারা ডাকাত একটা...’
ছেলেটা হাসল। বলল, ‘আরে আপনারা যে ক্লিনিকে গ্যাছেন ঐটাও ডাকাত। দেখেন না এমন সব ওষুধের নাম বলে একটাও এভেলেবল না। আর দেখেনে ঐ পাশের এ ক্লিনিক, যা ওষুধ লেখে সব আমাগো এখানে পাওয়া যায়।’
বললাম, 'ওহ! তাই। তা মানে কি আপানগো লগে ঐ ক্লিনিকের চুক্তি আছে মনে হয়...’
‘তা একটু আছে কিন্তু আমরা দাম কিন্তু বেশি রাখি না।’
হঠাৎ একটা হট্টগোল শোনা গেলো। লোকজন দৌড়াচ্ছে। গলির ভেতর এগিয়ে আসছে ভীত সন্ত্রস্ত মানুষের দল। ছেলেটা আমাকে বের হতে বলেই দ্রুত দোকানের শার্টার ভেতর থেকে নামিয়ে দিলো। আমি দ্রুত হেঁটে ক্লিনিকের নিচে গিয়ে দাঁড়ালাম। শুনলাম সামনেই মেইন রোডে একটা বাসে পেট্রোল বোমা মেড়েছে। বেশ কয়েকজন আগুনে আহতও হয়েছে শুনলাম।
চার.
কি করব বুঝতে পারছিলাম না। সূর্যটা ঢলে পড়েছে আঁধার এসে শাসন করতে শুরু করেছে চারপাশে। বাসে আগুন দেয়ার ঘটনার পর আধাঘন্টা পেরিয়ে গেছে। ধীর পায়ে হেঁটে মেইন রোডের দিকে এসেছি। ডিসপেনসারির ছেলেটা দোকান খুলেছে অর্ধেকটুকু। পোড়া গন্ধ নাকে লাগছে। রাস্তার ওপাশে কালো একটা বাসের পোড়া কংকাল। আশেপাশে অনেক পুলিশ। রীতুর কথা মনে পড়ল। মোবাইলটা হাতে নিলাম। রীতুর কল এসেছিল। টের পাইনি। রেগে যাবে নিশ্চিত। দ্রুত ফোন দিলাম। একটু রেগছে তবে জানাল ও শুনেছে এদিকে রাস্তার অবস্থা ভালো না। জানালাম আগুনের কথা।
বললাম, ‘তুমি কোথায়?’
‘বান্ধবীর বাসা থেকে বের হচ্ছি। তুমি আর দেরী করো না। চলে আস।
‘বাস টাস তো পাচ্ছি না। ওদিকের কি অবস্থা। মারামারি হতে পারে ওদিকেও।’
‘তাহলে কি চলে যাব বাসায়?- ঠিকাছে। ভালো দেখা আর হলো না। এ বছর দেখা বাদ, আবার দেখা হবে আগামী বছর ২০১৪ সালে।’
‘না না, ঠিকাছে একটু দাঁড়াও আমি আসছি, দেখি একটা সিএনজি নিয়েই আসি। তোমার কিছু হবে নাতো। আন্দোলন তো বিরোধী দল করছে। তোমার বাবা এলাকার বড় নেতা। বিরোধী দলের নেতা। তোমার কি হবে?’
‘এসব কথার মানে কি? ফাজলামি করছো। আমি কি দল করি নাকি। আর শোন আগুন দল মত দেখে না, সে সবাইরেই পোড়ায়, আমাদের সমাজে মানুষের মনে মনে এখন আগুন আর আগুন, এ আগুনে সবাই পুড়বে, সবাই। ’
‘আমি তুমিও নিশ্চয়...তবে আমাদের মনে কিন্তু অন্য আরেক আগুন বাস করে...ভালোবাসার সে আগুনে...’
‘তুমি কি আসবে?
‘এইতো এইতো...আই সিএনজি যাবে...’
পরিশিষ্ট.
শ্যামলীর মোড় পেরিয়ে আরও সামনে ডানে গলিতে মোড় নিতেই একদল মুখ ঢাকা লোক আমাদের সিএনজি অটোকে আটকেছিল। আমি কি করব ভেবে নেয়ার আগেই কেউ একজন সিএনজির সামনের দিকে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল। দৌড়ে চলে যাবার আগে আরও কেউ একজন সিএনজিটাকে ধাক্কা দিযে উল্টে দিয়েছিল। আমি ছিটকে পড়েছিলাম। তখনও জ্ঞান ছিলো। ড্রাইভাড়ের আর্ত চিৎকার আমার জ্ঞান হারাতে দেয়নি। আমার ডান পায়ের দিকে প্যান্টে আগুন এসে জড়িয়ে ধরেছিল। কয়েকজন লোক এগিয়ে এসেছিল সাহায্যে তাদেরই কেউ কিছু দিয়ে বাড়ি দিয়ে প্যান্টের আগুন নিভিয়েছিল। অনেক জ্বলছিল পা’টা। বাম হাতটাও ব্যথা করছিল। নাড়াতে পারছিলাম না। সম্ভবত ভেঙেছে। নিজের প্রতি খেয়াল একটু কমিয়ে ড্রাইভারের দিকে তাকালাম। কালো একটা মূর্তি যেন নিথঢ় পড়ে আছে। নড়ছে যদিও, তার গায়ে লাগা আগুন দুটো ছেলে নিজ গায়ের কাপড় খুলে প্যাঁচিয়ে নিভিয়েছে। ড্রাইভারের জন্য আমার খুব মায়া হচ্ছে। আমার মোবাইলটা বাজছে। মোবাইলটা ভেঙেছে, কল আসছে কিন্তু রিসিভ করা গেলো না। কাউকে অনুরোধ করলাম রীতুর নম্বরে একটা ফোন করতে। হয়তো রাগান্বিত রীতু খুব মেজাজ নিয়ে ফোন রিসিভ করেছিল, কিন্তু একটু পরেই সেই অচেনা লোকটির মুখে সব শুনে মেজাজ থেমেছিল নিশ্চিত, আমি কল্পনায় রীতুর সুন্দর মুখটা দেখতে পাচ্ছিল্লাম , সেখানে সুন্দর দুখানি টানাটানা চোখে পানি ঝরছিল আমি স্পষ্ট দেখছিলাম। আমি কথা বললাম, ‘বাবার দোকানে ছুটে যেতে বললাম।’
রীতু একটুও দেরী করেনি। বাবাকে জানানো মাত্রই বাবা ছুটে এসেছিলেন। আমাকে কাছেই একটা ক্লিনিকে নেয়া হয়েছিল। রীতু আসতে চেয়েছিল। বাবা ওকে দোকানের এক কর্মচারীকে দিয়ে বাসায় পৌঁছে দিয়েছিলেন জোড় করে। বাবা বুঝেছিলেন বিষয়টি। উনি সব বোঝেন। উনি তো বাবা। উনি তো কর্তা। কেবল দেশের কর্তারা সব বোঝে না। রীতু পরদিন সকালে এসেছিল।
ড্রাইভারের খোঁজ নিচ্ছিলাম। কেউ খোঁজ দিতে পারলো না। বাবা কেবল জানাল আমাকে যখন ক্লিনিকে নিয়ে আসছিলেন তখন একটা এম্বুলেন্সে তাকে ওঠানো হচ্ছিল। একটু সুস্থ হয়ে দুদিন পরে ভাঙা হাতে ব্যান্ডেজ নিয়ে বাসায় ফিরলাম। বড় আপু বা দুলাভাই কেউ একবারও দেখতে এলো না। প্রথম রাতে মা একবার এসেছিলেন, খুব কেঁদেছিলেন।
...ঘরে ঢুকে দেখি বড় আপু এসেছেন। খুব মেজাজে মাকে বলছেন, ‘এইডা কোন দ্যাশ হইলো। কোন স্বাধীনতা নাই। শালার আগুন লাগাইবার আর সময় পাইলো না। আর ভোদাইটা কেনো বাস থুইয়্যা সিএনজিতে উঠসে। ওরে তোমরা কি কারণে যে টাকা পয়সা দাও না? ওরা কি ভাববো? এত কাছে আমার বাবার বাড়ী। একটু খাবারও ওর মার জন্য পাঠাতে পারতেছো না। বলোতো মুখ থাকে আমার। বাবা একটু কষ্ট করে নিয়ে গেলেই তো পারত।’
বেজায় ক্ষুব্ধ হলাম। বললাম, ‘আপু আজ থেকে আমি আবার নিয়ে যাব । ও কাজ এক হাতেই করা যায়।’
মা বললেন, ‘আর ক’দিন থাকবে তোর শাশুড়ি হাসপাতালে?’...
আমার শুনতে ইচ্ছা করছিলো না। টিভি ছেড়ে সোফায় শুলাম। খবরে জানালাম ঐ ড্রাইভারটি আজ সকালে মারা গেছে ঢাকা মেডিক্যালে। খুব কষ্ট পেলাম নির্জন মনে। পণ করলাম লোকটার পরিবারকে আমি খুঁজে বের করবই।